উপকূল, শব্দটি শুনলেই যে ছবিগুলো আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো নদী ভাঙ্গন, খাবার পানির অভাব, লোনা পানিতে শিশুদের উচ্ছ্বাস।

এযাবৎকাল বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রিকায় পাতায় পড়েছি,আবার কোনো ঘূর্ণিঝড় এলেই টিভির শিরোনামে গাবুরা, পদ্মপুকুরের ভয়াবহ চিত্র দেখে এসেছি আমরা।

সম্প্রতি আমার উপকূল ভ্রমণের সুযোগ হয়েছে। তখন উপকূল এবং উপকূলের মানুষদের খুব কাছ থেকে দেখেছি । আজ সেই উপকূলের গল্প শোনাবো আপনাদের।

সুন্দরবনের কোল ঘেষে শ্যামনগর উপজেলা যার অববাহিকায় রয়েছে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া, চুনা, মালঞ্চ নদী। যেসব নদী বেশ খরস্রোতা, যে কপোতাক্ষ দেখে আমরা বড় হয়েছি, সেই কপোতাক্ষ এবং উপকূলের কপোতাক্ষ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারায় বহমান।

উপকূল নিঃসন্দেহে সুন্দর, ভয়ংকর সুন্দর। উপকূলের মানুষের প্রধান জীবিকা নদী ও সুন্দরবনের উপর নির্ভরশীল। কেউ নদীতে মাছ ধরে আবার কেউ সুন্দরবনে মধু বা গোলপাতা সংগ্রহের কাজ করে।

আপনি যদি খোলপেটুয়া নদীটি পার হয়ে গাবুরা ইউনিয়নে প্রবেশ করেন তাহলে আপনার উপলব্ধ হবে আসল উপকূলের সৌন্দর্য বা দুর্দশাটা কোথায়।

খোলপেটুয়া নদীটি আপনাকে পার হতে হবে ট্রলারে বা নৌকায়। মোটর বাইক বা সাইকেলগুলোও দিব্যি নৌকা চড়ে পার হয়ে যাচ্ছে।

আমরা যখন নদীটি পার হচ্ছি, তখন নৌকাটা এমন ভাবে এদিক ওদিক দুলছে, এই বুঝি আমরা নদীতে পড়ে যাব এমনটা বোধ হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে একদমই নিঃসংকোচে কয়েকটা বইখাতা হাতে নৌকার গলুইয়ে বসে আছে গাবুরার মাধ্যমিক পড়ুয়া একটি ছেলে। যাকে প্রতিদিন নদী পার হয়ে এপারে আসতে হয়, ভালো শিক্ষকের কাছে পড়ার জন্য। কখনও যদি আকাশে মেঘ দেখা যায়, অংকটা শেষ না করেই মাষ্টার মশায় গাবুরার ছেলেমেয়েদের ছুটি দিয়ে দেন। যেন নদী হিংস্র রূপ ধারণের আগেই তারা নিরাপদে মায়ের কোলে ফিরতে পারে। এমনটায় উপকূলের শিক্ষা ব্যবস্থা।

নদী পার হওয়ার সময় আপনার চোখে ধরা পড়বে সারি সারি নৌকা নদীর বুকে, তারা মাছ ধরছে। জালে কেমন মাছ বাঁধবে তার উপর নির্ভর করে তাদের ঘরে কী বাজার যাবে। শোনা যায় কোনো মৌসুমে এমন হয় যে তাদের ঘরে চাল নিয়ে ফেরায় মুশকিল হয়ে পড়ে।

নদীটি পার হলে আপনি তখন উপকূলীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার চরম ভোগান্তির শিকার হবেন৷ এক থেকে দেড় ফিট চওড়া বেঁড়ি বাঁধের উপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে সবাই, বুক দুরু দুরু সাহস নিয়ে আপনিও তাদের অনুসরণ করবেন এবং আপনি যদি চালক হিসেবে দক্ষ হয়ে থাকেন তাহলে পথটি অতিক্রম সম্ভব, নয়ত খোলপেটুয়া টেনে নিতে পারে আপনাকেও। একটু ভিতরে ঢুকলে সম্পূর্ণ কাঁচা মাটির রাস্তা যা একটু বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে। টানা দুদিন ঝড় বৃষ্টি হলে, যোগাযোগ ব্যবস্থা যেন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাদের। এই হলো উপকূলের যোগাযোগ ব্যবস্থা।

প্রখর রৌদ্রেও নদীর তীর ঘেষে একদল নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরীদের তিন কোণা জাল টানতে দেখা যায়। তারা গলদা ও বাগদার পোনা ধরছে। একদল শিশুও রয়েছে সে দলে, তারা ছোট ছাঁকনি জাতীয় কিছু দিয়ে পোনা ধরার চেষ্টা করছে, তারপর পানি পূর্ণ বোতলে সেই পোনা জমা করছে। তারা এই পোনা প্রতিটি দুইটাকা দরে হাটে বিক্রি করবে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা তবুও একদল শিশুকিশোরকে নদীর তীরে খেলা করতে বা মাছ ধরতে দেখা যায়। আমার উৎসুক মন জানতে চাই তাদের কী জ্বর, স্বর্দি, কাশি হয়না? আমার সহকর্মীর সরল উত্তর, তাদের জন্ম-মৃত্যু-বেঁচে থাকা সবই এই নদীতেই, তারা জলজ হয়ে গেছে যেন!

আপনি কী জানেন? গাবুরায় যাওয়ার পর আপনি যদি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে আপনার চিকিৎসার জন্য সেখানে কোনো হাসপাতাল নেই। আর যদি মধ্য রাতের ঘটনা হয় এটি তাহলে? রাস্তাঘাট তো দেখলেনই, মাঝরাতে ঘাটে নৌকা থাকলেও মাঝি কী থাকবে? আর যদি বর্ষার মৌসুম হয়? উপকূলের মানুষের জীবনকে অনিশ্চিত করে রাখে সুচিকিৎসার অভাব। যার শিকার হতে হয় মধ্য রাতে হঠাৎ প্রসব বেদনায় আতকে ওঠা মায়ের পরিবারকে। এই হলো উপকূলের চিকিৎসা ব্যবস্থা।

যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা সবই সেখানে অনুন্নত, অবহেলিত । কিন্তু কেন?

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছি আমরা। রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন দেশ, শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে এখন উন্নয়নের জোয়ার। তবুও কেন অবহেলিত ৩৩ বর্গ কিলো মিটারের প্রায় ৪০ হাজার মানুষের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা? কেন উপকূলের শিশুরা-মায়েরা অনিরাপদ?

উপকূলের একটা বিষয় আমাকে কিছুটা অবাক করেছে তা হলো, দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরাতে একটি ইউনিয়ন পরিষদ নেই! একটি ইউনিয়ন পরিষদের একটি ভবন থাকে, কতগুলো কক্ষ থাকে, কতগুলো সরকারি সেবা সেখান থেকে জনসাধারণ পেয়ে থাকে। তাহলে একটি ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়া গত ৫০ বছরে কীভাবে এই সেবা সঠিকভাবে জনসাধারণের কাছে পৌঁছেছে?

এই ছিল আমার উপকূল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।

ও হ্যাঁ, একটি বিষয় না বললেই নয়। বাঙালি সেই প্রাচীনকাল থেকেই তাদের আতিথ্যেয়তার জন্য সুপরিচিত। বাঙালি তার হৃদয় নিঙড়ানো ভালবাসার সর্বোচ্চটা দিয়ে সর্বদা অতিথি আপ্যায়ন করে থাকে। উপকূলেও তার কমতি ছিল না। উপকূলের সৌন্দর্য এবং আতিথ্যেয়তা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

আর সবখানের চিত্র কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেয়। উপকূল তার সৌন্দর্যকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করুক৷ উপকূলের সাধারণ মানুষ নিরাপদ আশ্রয় লাভ করুক এই প্রত্যাশায় আজকের লেখনী এপর্যন্তই।

এভাবেই নদী থেকে চিংড়ির পোনা ধরছেন শিশুরা